ফুড প্রসেসিং কী? এর গুরুত্ব ও ইতিহাস
- আপডেট সময় ০৩:৫০:০৬ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৩ অক্টোবর ২০২৪
- / ৬২ বার পড়া হয়েছে
ফুড প্রসেসিং কী? এর গুরুত্ব ও ইতিহাস
ফুড প্রসেসিং: সংজ্ঞা, ইতিহাস ও গুরুত্ব
ফুড প্রসেসিং বলতে বোঝায় খাদ্য উপকরণগুলিকে বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রস্তুত, সংরক্ষণ এবং উপভোগযোগ্য করে তোলা। এটি একটি বিস্তৃত প্রক্রিয়া যা খাদ্যের রূপান্তর ঘটিয়ে তাকে দীর্ঘস্থায়ী, স্বাস্থ্যকর, এবং সহজে ব্যবহারযোগ্য করে তোলে। এই প্রক্রিয়ায় কাঁচা খাদ্য উপকরণকে ফরমাল পদ্ধতিতে যেমন রান্না, ফ্রিজিং, ক্যানিং, শুকানো, পাস্তুরাইজেশন এবং প্যাকেজিং করা হয়। খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শুধু খাবারের সংরক্ষণ নয়, বরং এর স্বাদ, পুষ্টিগুণ, এবং স্থায়িত্ব বৃদ্ধির কাজেও ব্যবহৃত হয়।
ফুড প্রসেসিং-এর ইতিহাস
ফুড প্রসেসিং-এর ইতিহাস মানব সভ্যতার সাথে নিবিড়ভাবে জড়িত। প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ খাদ্য সংরক্ষণের পদ্ধতি আবিষ্কার করে। বিশেষত শিকারি-সংগ্রাহকদের যুগে খাদ্যকে দীর্ঘ সময় সংরক্ষণ করার জন্য শুকানো বা লবণ দিয়ে সংরক্ষণ করার পদ্ধতি ব্যবহৃত হতো। এর ফলে খাবার বেশি দিন ভালো থাকত এবং খাদ্য উৎসের অভাব হলে তারা সেই খাবার ব্যবহার করতে পারত।
প্রাচীন ফুড প্রসেসিং পদ্ধতি
প্রাচীন সভ্যতাগুলিতে ফুড প্রসেসিং-এর বেশ কিছু জনপ্রিয় পদ্ধতি দেখা যায়। যেমন, মিশরীয়রা খাদ্য সংরক্ষণের জন্য শুঁটকি মাছ শুকানোর পদ্ধতি ব্যবহার করত, রোমানরা মাংস এবং মাছ সংরক্ষণ করতে লবণ ব্যবহার করত। এই সময়ে বেকিং এবং ফারমেন্টেশন পদ্ধতিরও ব্যবহার শুরু হয়েছিল, যা আজও বহাল রয়েছে।
শিল্পবিপ্লব ও ফুড প্রসেসিং-এর বিকাশ
১৮শ শতাব্দীর শেষের দিকে শিল্পবিপ্লবের মাধ্যমে ফুড প্রসেসিং-এর ব্যাপক পরিবর্তন আসে। নতুন নতুন যন্ত্রপাতি এবং প্রযুক্তির উদ্ভাবনের ফলে খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ আরও উন্নত এবং সহজ হয়ে ওঠে। ১৮০৯ সালে নিকোলাস অ্যাপার্ট প্রথম বাণিজ্যিক ক্যানিং প্রক্রিয়ার আবিষ্কার করেন। এর ফলে বিভিন্ন ধরনের খাবারকে দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়।
১৯শ শতাব্দীতে ক্যানিং এবং রেফ্রিজারেশনের ব্যাপক জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়, যা খাদ্য সংরক্ষণকে আরও সহজ এবং কার্যকরী করে তোলে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ফুড প্রসেসিং-এর চাহিদা আরও বেড়ে যায়, কারণ খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে এবং সেনাদের দীর্ঘমেয়াদী খাবার সরবরাহের জন্য নতুন নতুন প্রসেসিং পদ্ধতির প্রয়োজন হয়েছিল।
আধুনিক ফুড প্রসেসিং
বর্তমান যুগে ফুড প্রসেসিং শিল্পে বিভিন্ন অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে। খাদ্য প্রক্রিয়াজাত করার ক্ষেত্রে রোবোটিক্স, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI), এবং স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রপাতির ব্যবহার বেড়েছে। আজকের দিনে প্যাকেজিং, কোল্ড স্টোরেজ, ফ্রিজিং, এবং খাদ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনায় উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। এছাড়া ফুড প্রসেসিং-এর মাধ্যমে বিভিন্ন নতুন পণ্যও বাজারজাত করা হচ্ছে, যেমন হিমায়িত খাদ্য, প্রি-কুকড খাবার, এবং ইনস্ট্যান্ট খাদ্যপণ্য।
ফুড প্রসেসিং-এর গুরুত্ব
১. খাদ্য নিরাপত্তা বৃদ্ধি
ফুড প্রসেসিং-এর মাধ্যমে খাদ্যের সংরক্ষণযোগ্যতা বাড়ানো হয়। পাস্তুরাইজেশন, ক্যানিং, এবং ফ্রিজিং-এর মতো পদ্ধতিগুলির মাধ্যমে খাবারে ব্যাকটেরিয়া বা অন্যান্য ক্ষতিকর মাইক্রোঅর্গানিজম ধ্বংস করা সম্ভব হয়, যা খাবারকে নিরাপদ করে তোলে। এর ফলে খাদ্য সংরক্ষণের মেয়াদ বৃদ্ধি পায় এবং খাদ্য দূষণের ঝুঁকি কমে।
২. পুষ্টির মান সংরক্ষণ
ফুড প্রসেসিং-এর মাধ্যমে খাদ্যের পুষ্টিগুণ বজায় রাখা সম্ভব হয়। উদাহরণস্বরূপ, পাস্তুরাইজেশনের মাধ্যমে খাদ্যে থাকা ভিটামিন এবং মিনারেল সুরক্ষিত রাখা যায়। কিছু খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ পদ্ধতি যেমন সঠিকভাবে শুকানো বা ফ্রিজিং করার মাধ্যমে খাদ্যে প্রয়োজনীয় পুষ্টিগুণ অটুট রাখা সম্ভব।
৩. খাদ্য অপচয় রোধ
খাদ্য প্রসেসিং-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা হচ্ছে খাদ্য অপচয় রোধ করা। বিভিন্ন ধরনের খাদ্য প্রক্রিয়াজাত করে যেমন শুকানো, ক্যানিং, এবং ফ্রিজিং করে খাদ্য অপচয় কমানো যায়। এর ফলে খাদ্যের অভাব পূরণ করা সহজ হয় এবং বৈশ্বিক খাদ্য চাহিদা মেটানো সম্ভব হয়।
৪. বহুমুখী খাদ্য তৈরি
ফুড প্রসেসিং-এর মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের খাদ্য উৎপাদন করা যায়। প্রসেসিং-এর মাধ্যমে নতুন নতুন স্বাদের এবং ধরনগুলোর খাবার তৈরি করা সম্ভব, যেমন ইনস্ট্যান্ট নুডলস, ফাস্ট ফুড, জুস, এবং স্ন্যাকস। এসব খাবার সহজে প্রস্তুতযোগ্য এবং দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা যায়।
৫. খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থা উন্নত করা
বিশ্বব্যাপী খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থা উন্নত করার ক্ষেত্রে ফুড প্রসেসিং-এর ভূমিকা অপরিসীম। প্রসেসড ফুড দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা যায়, যা দূরবর্তী স্থানেও সহজে পাঠানো সম্ভব। এতে করে খাদ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে সময় এবং খরচ সাশ্রয় হয়।
৬. অর্থনৈতিক উন্নয়ন
ফুড প্রসেসিং শিল্প কৃষি এবং গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই খাতে বিনিয়োগের ফলে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয় এবং স্থানীয় অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। কৃষি উৎপাদিত খাদ্য সামগ্রীকে প্রক্রিয়াজাত করে মূল্য সংযোজন করা সম্ভব হয়, যা কৃষকদের আয় বাড়াতে সহায়তা করে।
চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা
যদিও ফুড প্রসেসিং-এর অনেক সুবিধা রয়েছে, তবুও কিছু চ্যালেঞ্জও বিদ্যমান। যেমন, অতিরিক্ত প্রসেসিং-এর কারণে কিছু ক্ষেত্রে খাবারে পুষ্টিগুণ কমে যায় বা অতিরিক্ত চিনি, লবণ, বা চর্বি যোগ করার কারণে স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। তাই খাদ্য প্রক্রিয়াকরণের ক্ষেত্রে সচেতনতা এবং স্বাস্থ্যকর পদ্ধতি অনুসরণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ভবিষ্যতে ফুড প্রসেসিং-এর ক্ষেত্রে আরও উন্নত প্রযুক্তি ও পদ্ধতির ব্যবহার দেখা যাবে। পরিবেশবান্ধব প্যাকেজিং, কৃত্রিম প্রোটিন উৎপাদন, এবং খাদ্য বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দিকে আরও বেশি জোর দেওয়া হবে। এছাড়া খাদ্য প্রক্রিয়াকরণের সময় পুষ্টিগুণ বজায় রাখা এবং স্বাস্থ্যকর খাদ্য উৎপাদনের দিকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হবে।
ফুড প্রসেসিং একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া যা খাদ্য নিরাপত্তা, পুষ্টি সংরক্ষণ, এবং খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। মানব সভ্যতার প্রথম দিক থেকেই ফুড প্রসেসিং-এর গুরুত্ব ছিল, তবে বর্তমান সময়ে এর প্রয়োজনীয়তা আরও বেড়েছে। খাদ্য প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে বৈশ্বিক খাদ্য চাহিদা পূরণ, খাদ্য অপচয় রোধ, এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে। ভবিষ্যতে উন্নত প্রযুক্তি এবং স্বাস্থ্যকর পদ্ধতির মাধ্যমে ফুড প্রসেসিং শিল্প আরও বিকশিত হবে এবং বৈশ্বিক খাদ্য সমস্যার সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
➤ জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এর ফুড প্রসেসিং লেভেল- ২ CS ডাউনলোড এর জন্য ভিজিট করতে – ক্লিক করুন
বর্তমানে সরকার বিনামূল্যে বিভিন্ন দক্ষতা সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ প্রদান করছেন। বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড ও জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এর মূল্যায়নের মাধ্যমে দক্ষতার লে্ভেল অনুযায়ী যুগোপযোগী ও আন্তর্জাতিক মানের সনদ প্রদান করা হচ্ছে। যার প্রসার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই প্রশিক্ষণ সংক্রান্ত যেকোন আপডেট তথ্য পেতে ঘুরে আসতে পারেন বিডিস্কিলস.ওআরজি এর ফেসবুক পেজ, কমিউনিটি গ্রুপ অথবা ওয়েবসাইট ও গ্রুপ থেকে।